Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

Image
Title
ইতিহাস-ঐতিহ্যে কলারোয়া
Details

কলারোয়া মঠ-মন্দির

 

প্রকৃতির সাথে পুরাকীর্তি যাদের সমানভাবে আকর্ষণ করে তাদের আসতে হবে কলারোয়ার সীমান্ত জনপদ সোনাবাড়িয়ায়। মধ্যযুগীয় নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে গোটা সোনাবাড়িয়া জুড়ে। এমনই এক পুরাকীর্তির  নাম মঠবাড়ি মন্দির গুচ্ছ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়  সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
কলারোয়া উপজেলা সদর থেকে ৯.৬ কিলোমিটার দূরে সোনাবাড়িয়া গ্রামে এই প্রতœস্থলটির অবস্থান। প্রায় পৌনে ৪শ বছরের পুরানো ৬০ ফুট উঁচু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা টেরাকোটা ফলক খচিত পিরামিড আকৃতির এই মঠ-মন্দির প্রাচীন স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ঐতিহাসিক মঠ-মন্দিরটি এখনই সংরক্ষণ করা না গেলে একটি জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মো. মোশারফ হোসেনের লেখা  ‘প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উল্লেখ করা হয়েছে এ মন্দির ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। যেটি সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়েও লেখা রয়েছে। এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় এর ত্রিতলবিশিষ্ট নবরতœ মন্দির। এটিই ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এর সাথে লাগোয়া রয়েছে দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির। এই মন্দিরও গুচ্ছের দক্ষিণে একটি অসম বাহুবিশিষ্ট চৌকো দিঘি আছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচের তলা ১০.৮২ মি./৩৫ফু.-৬ ই. বর্গাকার ভিত পরিকল্পনায় নির্মিত। এর দ্বিতলের মাপ ১০ মি./৩২ফু.-১০ই.ী ৯.৯৮ মি./৩২ ফু.-৯ ই. এবং ত্রিতল ৭.৪৬মি./২৪ ফু.-৬ ই.ী৭.১৬ মি./২৩ ফু.-৬ ই.। ফলে মন্দিরটি একটি পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে। দক্ষিণমুখী এই মন্দিরের নিচের তলার ভেতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা অলিন্দ। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মি./২০ ফু.-২ ই.পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং ১.৩২ মি./৪ ফু.-৫ ই. চওড়া একটি মন্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে প্রকোষ্ঠ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পেছনে রয়েছে একটি অলিন্দ, যেখানে দ্বিতল ভবনে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণমুখী কোঠা। এর পরিমাপ ২.২৮ মি./৭ফু.-৬ ই. ী ১.৯৮মি./৬ ফু,-৬ ই.। ত্রিতল ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। মোশারফ হোসেনের ওই জরিপ বইয়ে আরো বলা হয়েছে, শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সেমি./১ ফু.-৬ ই. উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমাণ্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধমুখী গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রতœ রয়েছে। এটি তাই ‘নবরতœ স্মৃতি মন্দির’। নবরতœ বা শ্যামসুন্দর মঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আরও একটি দক্ষিণমুখী মন্দির আছে। এটি ‘দুর্গা মন্দির’ নামে পরিচিত। শ্যামসুন্দর মন্দিরের গা ঘেঁষে পূর্বমুখী মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেমি./৩ ফুট উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। এর ওপর একটি ভাষ্য ফলক পাঠোদ্ধার অনুপযোগী অবস্থায় সংস্থাপিত আছে। এর ছাদ চৌচালা, কার্ণিশ ধনুকাকারে বাঁকা এবং কোণগুলো কৌণিক। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। বর্তমানে এ মন্দিরগুচ্ছ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই মঠের পাশে আরও ৮ টি (মতান্তরে ১০টি) মন্দির ছিল। অনেকের মতে, রাম হংস পরমানন্দ এক সময় মন্দিরগুলো পরিদর্শনে এসেছিলেন। জানা যায়, মঠ মন্দির গুচ্ছের অল্প দক্ষিণে ‘জমির বিশ্বাসের পুকুর’ নামে যে জলাশয়টি আছে তার পাকা ঘাটে ব্যবহৃত ইটের সাথে ‘অন্নপূর্ণা মন্দির’ এর ইটের মিল পাওয়া যায়। তাতে ধারণা করা হয় পুকুরটি একই সময়কালের নিদর্শন। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক পুকুরটি বিষমবাহুর আকার ধারণ করেছে। উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সম্পাদক সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী, ইউপি সদস্য মনিরুল ইসলামসহ এলাকার অনেকের মতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মঠটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি হতে পারতো সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ সকল মানুষের কাছে দর্শনীয় স্থান ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

 

সোনাবাড়িয়া শ্যামসুন্দর মন্দির

 

ইতিহাসের সাথে প্রকৃতি যাঁদেও সম্ন ভাবে টানে তাঁদেরকে আসতে হবে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সোনাবাড়িয়া গ্রামে। এখানে রয়েছে টেরাকোটার নির্মাণ শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন প্রায় আড়াই'শ বছর আগে রড সিমেণ্টের ঢালাই বা কড়ি বর্গা বিহিন নির্মিত সাতক্ষীরার কলারোয়ায় "সোনাবাড়িয়া মঠ" বা শ্যামসুন্দর মন্দিরের তিনতলা ভবন কালের স্বাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সংস্কারের অভাবে ভবনের উপর গাছপালা জন্মে, ফাটল ধরে ও লোনায় ধ্বসে পড়তে শুরু করেছে। ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে "সোনাবাড়িয়া মঠ" এর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে কলারোয়া উপজেলায় রক্ষিত এক নজরে বোর্ডে। এই মঠের গায়ে খোদাই করা শিলালিপিতে "শ্যাম সুন্দর নবরত্ন মন্দির" নামাঙ্কিত রয়েছে।
এই মঠের মূল ভবনের গা ঘেঁষে পশ্চিমে জগন্নাথের মন্দিরের ছাদ ও দেওয়ালের অংশ বিশেষ ধ্বসে পড়েছে। পূর্ব দিকে ধবংস স্তূপের উপর নতুন করে শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। দক্ষিণে রয়েছে আর একটি ধ্বসে পড়া ভবনের অংশ বিশেষ। যার কোন সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় নি। ভবনে ব্যবহৃত ইটে খোদাই করা লেখার বেশীর ভাগ স্থান লোনায় ক্ষয়ে বিনষ্ঠ হয়ে গেছে। তবে যেটুকু লেখা অবশিষ্ট আছে তা এখনকার মত বাংলা হরফে নয়। কিছু শব্দ বর্তমান বাংলার মত হলেও অনেক অ্বর ্‌একেবারে বুঝা যায় না। বাংলা হরফের আদি রূপ বলে স্থানীয় ইতিহাস ও ভাষা তত্ব শিক্ষকরা মনে করেন। আর হরফের এই রূপ দেখে এর নির্মাণ কাল ৪/৫'শ বছর আগে কেউবা ৭/৮'শ বছর আগে বলে এসব শিক্ষকরা অভিমত ব্যক্ত করেন।
তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক মোঃ মোশারফ হোসেনের লেখা 'প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা' বইয়ের ৯৪ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামে উল্লেখ করা হয়েছে, এ মন্দির ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ(মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। যেটি সতীশ চন্দ্র মিত্রের বইয়েও লেখা রয়েছে।
আর এই মঠের বিশেষত্ব হচ্ছে এর তিনতালা ভবনের ছাদ কোন রড়, সিমেণ্টের ঢালাই বা কড়ি বর্গা ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। মঠের মূল ভবনের নীচতলায় ১৪ কুঠুরি এবং দ্বিতীয় তলায় ১৪ কুঠুরি। তৃতীয় তলায় রয়েছে ৭ কুঠুরি রয়েছে। আড়াই বর্গ হাতের এসব ক্ষুদ্রাকৃতির কুটুরি নির্মাণের উদ্দেশ্য সর্ম্পকে কিছু জানা যায়নি।
এসব কুঠুরির মধ্যোবর্তী স্থানে রয়েছে অন্ধকোটা। এত অন্ধকার যে দিনের বেলায়ও কিছুই দেখা যায় না। দিনের বেলায়ও আলো ছাড়া এ ঘরে প্রবেশ বিপদজনক। কারণ অন্ধকোটার মধ্যোস্থলে রয়েছে ইদাঁরা। পড়ে গেলে জীবন্ত ফেরার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই দর্শনার্থীরা কেউ আলো ছাড়া অন্ধকোটায় প্রবেশ করে না। কারণ আগেই পার্শ্ববর্তী লোকজন বহিরাগতদের সর্তক করতে ভুল করে না।
এছাড়া মঠের চূড়ায় বজ্র নিরোধক দণ্ডের সংগে পাশের পুকুরের পানির নীচের মাটিতে সংযোগ শিকলটি ছিড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির চর্তুদিকে আরো মন্দির ছিল বলে শুনা য়ায়। এরকম বেশ কিছু ধবংস স্তূপ পাশে দেখা যায়। কিন্তু মঠের মূল ভবনের উপর গাছপালা লতাগুল্ম জন্মেছে। লোনা ধরে ক্ষয় শুরু হয়েছে ভবনের। প্লাষ্টার ঘসে পড়ছে। ভবনটির অসংখ্য স্থানে ফাটল ধরেছে। যে কোন সময় ধ্বসে পড়তে পারে ভবনটি। তবে এই ধ্বংস স্তূপটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে খুবই গুরুত্ব বহন করছে।
স্থানীয় প্রবীণ হিন্দুরা জানায়, এক সময় "রামকৃষ্‌ঞ পরমহংস" এসে এই মঠে দুই মাস অবস্থান করেন। তাই হিন্দু ধর্মাম্বলীদের কাছে এটি পবিত্র মন্দির। এজন্য বিপদজনক হয়ে পড়া মঠ ভবনের পাশে টিনশেড নির্মাণ করে স্থানীয় হিন্দু ধর্মাম্বলীরা বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুজা অর্চনা করে আসছে।
এছাড়া ঐতিহাসিক নিদর্শনটি দেখতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের হিন্দুধর্মীয় পূর্ণার্থীরা আসে। এমনকি ভারতের বেলুড় মঠ, আমেরিকা, ব্রিটেন, সিংগাপুর অবস্থিত মঠের মহারাজেরা বিভিন্ন সময়ে সোনাবাড়িয়া মঠ পরিদর্শন করে গেছেন। সম্প্রতি ব্রিটেনের অধিবাসী ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডেভিট ম্যাকাসিন এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি দেখতে আসেন। কিস্তু দর্শনার্থী এসব গুণীজন ছাড়াও সাধারণ দর্শর্র্ণাীদের এক দণ্ড বিশ্রামের কোন ব্যবস্থা নেই মঠ চত্বরে।
২০১০ সালের জানুয়ারীতে এই মঠ দেখতে সোনাবাড়িয়া ঘুরে যান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ক লেখক মোঃ মোশারফ হোসেন। সাথে ছিলেন খুলনা জাদুঘরের একটি টিম। সে সময় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কতৃৃর্ক মঠ সংরক্ষণের এগিয়ে আসার আশ্বাস শুনা যায়।
এরপরে দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও মঠ রক্ষায় কোন সরকারী বা বেসরকারী কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট হচ্ছে সুরম্য ভবনটি। শতশত বছরের ধর্মীয় স্মৃতি চিহ্নটি রক্ষায় হিন্দু সম্প্রদায় সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।